শার্লক হোমস: ‘দি অ্যাডভেঞ্চার অফ দ্য নোবল ব্যাচেলার’

শার্লক হোমস: 'দি অ্যাডভেঞ্চার অফ দ্য নোবল ব্যাচেলার'

লর্ড সেন্ট সাইমনের বিয়ে এবং তারপরেই বিয়ে ভেঙে যাওয়ার অদ্ভুত কাহিনি অনেকের কাছেই এখন বাসি হয়ে গিয়েছে। নিত্যনতুন কলঙ্ক কাহিনি রটছে, চার বছর আগেকার ব্যাপারটা আর তেমন আগ্রহ জাগায় না। বিচিত্র এই রহস্য ভেদে কিন্তু শার্লক হোমসের একটা বড়ো ভূমিকা ছিল।

আমার বিয়ের কয়েক হপ্তা আগের ঘটনা। ঝড়বাদলার মাতামাতি চলছে বাইরে। জিজেল বুলেটে আহত প্রত্যঙ্গ টনটনিয়ে উঠছে—বহু বছর আগে আফগান লড়াইয়ে জখম হয়েছিলাম–কিন্তু মাঝে মাঝে ব্যথাটা বেশ চাগাড় দিয়ে ওঠে। চেয়ারে পা তুলে একরাশ খবরের কাগজ আর হোমসের নামে আসা এক বান্ডিল চিঠি নিয়ে বসে ছিলাম। একটা লেফাফার ওপর সিলমোহর আর মনোগ্রাম লক্ষ করার মতো। ভাবছিলাম খানদানি পত্ৰলেখকটি কে হতে পারে।

এমন সময়ে বৈকালিক ভ্রমণ সাঙ্গ করে বাড়ি ফিরল শার্লক হোমস। খামটা হাতে নিয়ে ছিঁড়ে ফেলে ভেতরের চিঠিতে চোখ বুলিয়ে বললে, ওহে, কেস খুব ইন্টারেস্টিং!

সামাজিক ব্যাপার নয় তাহলে?

একেবারেই না। পেশার ব্যাপার।

খানদানি মক্কেল নিশ্চয়?

ইংলন্ডের উঁচু মহলে যে কজন আছেন, তাঁদের একজনের চিঠি।

বল কী হে! অভিনন্দন রইল।

ওয়াটসন, মক্কেলের সমস্যাটাই আমার কাছে বড়ো–তার সামাজিক প্রতিপত্তি নয়। কাগজ তো পড়, লর্ড সেন্ট সাইমনের বিয়ের ঘটনা নিশ্চয় চোখ এড়ায়নি?

আরে না। দারুণ ইন্টারেস্টিং ঘটনা।

চিঠিখানা লর্ড সেন্ট সাইমনের লেখা। লিখেছেন :

মাই ডিয়ার মি. শার্লক হোমস,

আমার বিয়ের ব্যাপারে আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই আজ বিকেল চারটের সময়ে। অনুগ্রহ করে অন্য কাজ থাকলে তা বাতিল করবেন, কেননা ব্যাপারটা অত্যন্ত জরুরি। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের মি. লেসট্রেড রহস্য সমাধানে উঠে পড়ে লেগেছেন–তাঁর মতে আপনিও যদি এ-সম্পর্কে চিন্তা করেন, তাহলে সুরাহা হতে পারে।

আপনার বিশ্বস্ত
সেন্ট সাইমন।

চিঠিতে তারিখ পড়েছে গ্রসভেনর ম্যানসনের, লেখা হয়েছে পালকের কলমে, খানদানি লর্ড মশাই ডান হাতের কড়ে আঙুলে এক ফোঁটা কালিও লাগিয়ে ফেলেছেন চিঠি ভঁজ করতে করতে, বলল হোমস।

এখন তিনটে বাজে। চারটের সময়ে আসবেন লিখেছেন।

সেই ফাঁকে বিষয়টা একটু পরিষ্কার করে নেওয়া যাক, ম্যান্টলপিস থেকে লাল মলাট দেওয়া একটা বই পেড়ে আনল হোমস। পাতা উলটে বললে, এই তো ডিউক অফ ব্যালমোরালের দ্বিতীয় পুত্র লর্ড রবার্ট ওয়ালসিংহ্যাম দ্য ভেরে সেন্ট সাইমন। হুম! বয়স একচল্লিশ, বিয়ের বয়স। কলোনি শাসনব্যবস্থায় আন্ডার সেক্রেটারি ছিলেন। পররাষ্ট্র দপ্তরে সেক্রেটারি ছিলেন ওঁর পিতৃদেব। ধমনীতে আছে বাপ পিতামহের প্লান্টাজেনেট রক্ত, বিয়ের সুত্রে তাতে মিশেছে টিউডর রক্ত। খুব একটা কিছু জানা গেল না এ থেকে। ওয়াটসন, খবরের কাগজে কী দেখেছ বল তো?

কয়েক হপ্তা আগে মর্নিংপোস্টে প্রথম নোটিশটা বেরোয় পার্সোনাল কলমে। লিখেছে, জোর গুজব, সানফ্রান্সিসকো নিবাসী মি. অ্যালয়সিয়াস ডোরানোর মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হতে চলেছে ডিউক অফ ব্যালমোরালের দ্বিতীয় পুত্র লর্ড রবার্ট সাইমনের।

আগুনের দিকে লম্বা ঠ্যাং ছড়িয়ে হোমস বললে, বড় কাটছাঁট ছছাট্ট খবর।

গত হপ্তার শেষের দিকেও একটা খবর বেরিয়েছিল। শোনো :

খোলা বাজারের বিয়ের নীতির ফলে আমাদের দেশের জিনিসই পাচার হয়ে যাচ্ছে বাইরে। এ নিয়ে আইনকানুন করা দরকার। ব্রিটেনের খানদানি ফ্যামিলিতে হামেশাই বউ হয়ে আসছে সাগরপারের সুন্দরীরা। সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটেছে লর্ড সেন্ট সাইমনের ক্ষেত্রে। এত বছর বীরবিক্রমে আইবুড়ো থাকার পর তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার কোটিপতি-কন্যা হ্যাটি ডোরানের কটাক্ষ বিদ্ধ হয়েছেন। বিয়ে পর্যন্ত ঠিক হয়ে গেছে, যৌতুক ছয় অঙ্ক ছাড়িয়ে যাবে। ডিউক অফ ব্যালমোরালের ট্যাক যে গড়ের মাঠ, সে-খবরও দেশসুদ্ধ লোক জেনে গেছে। গত ক-বছর ধরে নিজস্ব ছবি বিক্রি করে সংসার চালিয়েছেন ভদ্রলোক। বাৰ্চমুরের ছোট্ট সম্পত্তি ছাড়া লর্ড সেন্ট সাইমনেরও কপালে কিছু জোটেনি। কাজেই বিয়ের ফলে লাভের কড়ি কেবল ক্যালিফোর্নিয়ার সুন্দরীই পাবেন না–লর্ড সেন্ট সাইমনও বর্তে যাবেন।

হাই তুলে হোমস বললে, আর কিছু আছে নাকি?

আছে। সেন্ট জর্জ গির্জায় সাদাসিধেভাবে বিয়ে হবে–খবর দিয়েছে মর্নিং পোস্ট। জনাছয়েক অন্তরঙ্গ বন্ধু কেবল নিমন্ত্রিত হবেন। বিয়ের পর ল্যাঙ্কাস্টার গেটের বাড়িতে যাবেন মি. ডোরান। দু-দিন পরে–মানে গত বুধবার আর একটা খবর বেরিয়েছে বিয়ে হয়ে গেছে। বর-বউ হানিমুন করতে যাবেন লর্ড ব্যাকওয়াটারের বাড়িতে। কনে অদৃশ্য হওয়ার আগে পর্যন্ত এই হল গিয়ে সব খবর।

কীসের আগে পর্যন্ত? সচমকে বলল হোমস।

লেডি সাইমন অদৃশ্য হওয়ার আগে পর্যন্ত।

অদৃশ্য হলেন কবে?

বিয়ের ব্রেকফাস্ট খেতে খেতে।

আচ্ছা! রীতিমতো ইন্টারেস্টিং আর নাটকীয় মনে হচ্ছে।

এ-রকম ঘটনা বড়ো একটা ঘটে না।

বিয়ের আগে অদৃশ্য হওয়ার ঘটনা আছে, এমনকী হানিমুনের সময়েও সটকান দেয় অনেকে। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি তো কেউ পালায় না। একটু খুঁটিয়ে বল শুনি।

গতকাল সকালে কাগজে একটা প্রবন্ধ বেরিয়েছে শোনো। শিরোনাম হল হালফ্যাশনের বিয়ের আসরে অভূতপূর্ব কাণ্ড!

লর্ড সেন্ট সাইমনের বিয়ে নিয়ে টি-টি পড়ে গেছে শহরে। কিছুতেই আর ধামাচাপা দেওয়া যাচ্ছে না।

সেন্ট জর্জ চার্চে মোট ছ-জনের উপস্থিতিতে বিয়ে হয়ে যায় দুজনের। গির্জে থেকে বেরিয়ে ল্যাঙ্কাস্টার গেটে মি. ডোরানের বাড়িতে সবাই যান। এইসময়ে মিস ফ্লোরা মিলার নামে এক নর্তকী হাঙ্গামার সৃষ্টি করে। লর্ড সাইমনের ওপর নাকি তার দাবি আছে। বাড়ির মধ্যেও ঢোকবার চেষ্টা করে কিন্তু ঢুকতে দেওয়া হয়নি।

এই হাঙ্গামা শুরু হওয়ার আগে লেডি সাইমন বাড়িতে ঢুকে পড়েছিলেন। প্রাতরাশ খেতেও বসেছিলেন। তারপর হঠাৎ শরীর খারাপ বলে উঠে যান। অনেকক্ষণ তাঁকে না-দেখে মি. ডোরান মেয়ের ঘরে গিয়ে আর তাকে দেখতে পাননি। কনের পরিচারিকা বলেছে, কোট আর টুপি নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেছেন লেডি সাইমন। মি. ডোরান তৎক্ষণাৎ পুলিশে খবর দেন। তদন্ত চলছে। নর্তকী মিস ফ্লোরা মিলারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে লেডি সাইমনের অন্তর্ধানের পেছনে নিশ্চয় তার হাত আছে।

ওয়াটসন, সব শোনবার পর বললে শার্লক হোমস, কেসটা এতই কৌতূহলোদ্দীপক যে হাজার প্রলোভনেও এ-কেস হাতছাড়া করতে আমি রাজি নই। দরজায় ঘণ্টা বাজছে। চারটেও বেজে গেছে। খানদানি মক্কেলটি এসে গেছেন নিশ্চয়।

ক্ষণপরেই ছোকরা চাকরের পেছন পেছন ঘরে প্রবেশ করলেন লর্ড সেন্ট সাইমন। বয়স যা-ই হোক না কেন, ঈষৎ হাঁটু বেঁকিয়ে কোলকুঁজো হয়ে হাঁটার দরুন একটু বয়স্কই মনে হয়। টুপি খোলার পর দেখা গেল চুলে পাক ধরেছে। ব্রহ্মতালুর চুল পাতলা হয়ে এসেছে। সাজগোজে শৌখিনতা আছে। ডান হাতে সোনার চশমার সুতো ধরে দোলাতে দোলাতে ঘরে ঢুকলেন প্রকৃতই অভিজাত কায়দায়। হুকুম করার জন্যেই যেন তিনি জন্মেছেন।

অভিবাদন বিনিময়ের পর লর্ড বললেন, মি. হোমস আপনি অনেকের কেস নিয়ে মাথা ঘামিয়েছেন, কিন্তু আমি যে-মহলের মানুষ, সে-মহল থেকে বোধ হয় আমিই প্রথম।

তারও ওপরের মহল থেকে আসা হয়ে গেছে। তিনি ছিলেন একটা দেশের রাজা। সেদিক দিয়ে বলতে পারেন আমার দর কমছে।

বলেন কী! কোথাকার রাজা?

স্ক্যান্ডিনেভিয়ার!

সর্বনাশ! তারও কি বউ নিখোঁজ হয়েছিল?

মাফ করবেন। গোপনীয়তা রক্ষা করা আমার পেশার ধর্ম। আপনি বরং বলুন খবরের কাগজে এই যে-খবরটা বেরিয়েছে, এটা ঠিক কি না।

কনের অন্তর্ধান সম্পর্কিত সংবাদে চোখ বুলিয়ে লর্ড সাইমন বললেন, ঠিক।

মিস হ্যাট্টি ডোরানকে প্রথম কবে দেখেন?

এক বছর আগে সানফ্রান্সিসকোয়।

যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন?

হ্যাঁ।

বিয়ের কথা পাকাঁপাকি হয়েছিল কি তখনই?

না।

কিন্তু বন্ধুত্ব নিবিড় হয়েছিল?

পরস্পরকে ভালো লাগত বলতে পারেন।

ওর বাবা খুব বড়োলোক?

প্রশান্ত মহাসাগরের পাড়ে ভদ্রলোক বলতে যে ক-জন আছেন, উনি তাদের পকেটে পুরে রাখতে পারেন।

এত টাকা করলেন কী করে?

খনির কাজে। বছর কয়েক আগে কানাকড়িও ছিল না। তারপর সোনার খোঁজ পেয়ে রাতারাতি লাল হয়ে গেলেন।

আপনার স্ত্রী-র চরিত্র কীরকম?

হাতের চশমা আরও জোরে দুলিয়ে আগুনের পানে তাকিয়ে বললেন খানদানি ভদ্রলোক, স্ত্রীর বয়স যখন বিশ, তখন পর্যন্ত খনি নিয়েই মেতে থেকেছেন আমার শ্বশুর–বড়োলোক হননি। তাঁবুতে রাত কাটিয়েছে, পাহাড়ে জঙ্গলে ঘুরেছে শিক্ষা পেয়েছে প্রকৃতির পাঠশালায় স্কুলে নয়। ইংলন্ডে যাদের আমরা টম বয় অর্থাৎ গেছো মেয়ে বলি, সে তাই। প্রকৃতি দুর্দান্ত, স্বাধীনচেতা, কোনো সংস্কারের বালাই নেই। খুদে আগ্নেয়গিরি বললেও চলে–আবেগ চেপে বসলে আর তর সয় না। মনস্থির করে তুড়ি মেরে, সেই অনুযায়ী কাজ করে তৎক্ষণাৎ অন্তরে তার আভিজাত্য দেখেছিলাম বলেই আমার নামের মর্যাদা তাকে দিতে প্রস্তুত হয়েছিলাম। আমি জানি সে নিজেকে বলি দেবে, তাও ভালো কিন্তু মর্যাদা যায় এ-রকম কিছুই করবে না।

কাছে ফটো আছে?

সঙ্গেই এনেছি, বলে একটা লকেট বাড়িয়ে দিলেন লর্ড। লকেটের মধ্যে হাতির দাঁতের ওপর পরমাসুন্দরী একজন তরুণীর মুখশ্রী অপূর্ব দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পী। নিবিড় কৃষ্ণচক্ষুর পানে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে লকেট ফিরিয়ে দিল হোমস।

বলল, ইনি লন্ডনে এলে নতুন করে অন্তরঙ্গতা আরম্ভ হয়। তাই তো?

ওর বাবা ওই কারণেই ওকে এনেছিলেন এখান। বিয়ের কথাও পাকা হয়ে যাবার পর বিয়ে পর্যন্ত হয়ে গেল। তারপর–

যৌতুকের টাকা পেয়ে গেছেন?

ওসব নিয়ে মাথা ঘামাইনি। খোঁজখবরও করিনি।

বিয়ে যেদিন হয়, তার আগের দিন দেখা হয়েছিল মিস ডোরানের সঙ্গে?

হ্যাঁ!

মেজাজ সরস ছিল কি?

ও-রকম খুশি চনমনে আর কখনো দেখিনি।

বিয়ে যেদিন হল, সেদিন সকালে মেজাজ কীরকম দেখলেন?

অত্যন্ত ভালো। বিয়ে শেষ না-হওয়া পর্যন্ত।

তারপর বুঝি মেজাজে চিড় লক্ষ করেছিলেন?

তা… হ্যাঁ, সেই প্রথম ওকে একটু অস্থির অবস্থায় দেখেছিলাম। সামান্যই ব্যাপার।

হোক সামান্য, বলুন আমাকে।

বেদির দিকে যাওয়ার সময়ে ফুলের তোড়াটা পড়ে যায় ওর হাত থেকে। এক ভদ্রলোক তৎক্ষণাৎ সেটা তুলে দিল ওর হাতে। তোড়ার ক্ষতি হয়নি–অথচ কথাটা জিজ্ঞেস করতেই একটা অসংলগ্ন জবাব দিল। বাড়ি ফেরার সময়ে গাড়ির মধ্যে মনে হল বেশ উত্তেজিত হয়ে রয়েছে সামান্য এই ব্যাপারে।

গির্জের মধ্যে তাহলে বাইরের লোক ছিল?

তা তো থাকবেই। গির্জে খোলা থাকলে ঘাড় ধরে কাউকে বার করে তো দেওয়া যায় না।

ভদ্রলোক লেডি সাইমনের বন্ধু কি?

কী যে বলেন! ভদ্রলোক বললাম ভদ্রতার খাতিরে। চেহারা একেবারেই সাদামাটা। ভালো করে তাকিয়েও দেখিনি।

লেডি সাইমন তাহলে গির্জেতে গেছিলেন মনের আনন্দ নিয়ে। বেরিয়ে এসেছিলেন মন খারাপ করে। বাড়ি এসে কী করলেন?

ঝিয়ের সঙ্গে কথা বলছিল।

কে সে?

নাম তার অ্যালিস। আমেরিকান মেয়ে। ওর সঙ্গেই এসেছে বাপের বাড়ি থেকে।

খুব মাই ডিয়ার ঝি বুঝি?

খুবই। বড্ড আশকারা পাওয়া ঝি। আমেরিকায় এসব ওরা বরদাস্ত করে, এখানে চলে না।

কতক্ষণ কথা বললেন ঝি-য়ের সঙ্গে?

মিনিট কয়েক।

কী কথা শুনেছিলেন?

গাঁইয়া ভাষায় কী যেন বলছিল লেডি সাইমন। জাম্পিং এ ক্লেম শব্দগুলো কেবল কানে এসেছিল। মানে বুঝিনি।

আমেরিকার গাঁইয়া ভাষায় অনেক মানে থাকে কিন্তু। তারপর উনি কী করলেন?

প্রাতরাশের টেবিলে গেলেন।

আপনার বাহুলগ্না হয়ে?

না। মিনিট দশেক থেকে উঠে পড়ল। বেরিয়ে গেল। আর আসেনি।

ঝি-টি কিন্তু এজাহারে বলেছে, ঘরে গিয়ে কোট আর টুপি নিয়ে বেরিয়েছেন লেডি সাইমন!

ঠিকই বলেছে। এর ঠিক পরে হাইড পার্কে ফ্লোরা মিলারের সঙ্গে তাকে হাঁটতে দেখা গেছে। সেই ফ্লোরা মিলার যে বাড়ি বয়ে এসে মামলা জুড়েছিল।

ফ্লোরা মিলারের সঙ্গে আপনার সম্পর্কটা কীরকম, একটু খুলে বলবেন?

ভুরু কুঁচকে কাঁধ ঝাঁকিয়ে লর্ড সাইমন বললেন, বছর কয়েক একটু যোগাযোগ ছিল–বান্ধবী বলতে পারেন। আদরের বান্ধবী। কিন্তু মেয়েরা আশকারা পেলে মাথায় উঠে যায়। আমার বিয়ের খবর পেয়ে যাচ্ছেতাই চিঠি লিখতে শুরু করলে। তখনই জানতাম, বিয়ের সময়ে হট্টগোল করতে পারে, আমার মুখে চুনকালি দেওয়ার চেষ্টা করতে পারে। হলও তাই। শ্বশুরবাড়িতে জোর করে ঢুকতে গেছিল, আমার স্ত্রী-র বাপান্তও করেছিল। কিন্তু আমি সাদা পোশকি দুজন পুলিশ মোতায়েন রেখেছিলাম দরজায়, এইরকম কিছু একটা হবে আঁচ করে। তারাই বের করে দেয় ওকে।

লেডি সাইমন শুনেছিলেন ধাক্কাধাক্কির ঘটনা?

না।

অথচ তাঁর সঙ্গেই ফ্লোরা মিলারকে হাইড পার্কে দেখা গেছে?

মি. লেসট্রেড সেই কারণেই সন্দেহ করেছেন ফ্লোরাই ষড়যন্ত্র করে সরিয়েছে লেডি সাইমনকে।

আপনার কি তাই মনে হয়?

না। সামান্য একটা মাছিকেও যে মারতে চায় না, তার পক্ষে এ-কাজ সম্ভব নয়। ফ্লোরা নির্দোষ। ঈর্ষায় মানুষ পালটে যায়।

দেখুন, আমার মনে হয় হঠাৎ এইরকম উঁচুদরের খেতাব পেয়ে, সমাজের উঁচু মহলের একজন হয়ে গিয়ে লেডি সাইমন মাথার ঠিক রাখতে পারেননি বলেই আমার বিশ্বাস।

বেসামাল অবস্থা, এই তো?

তা ছাড়া আর কী? হাপিত্যেশ করে থেকেও অনেকে যা পায়নি–ও তা সহজেই পেয়ে যখন চলে গেছে তখন ওকে অপ্রকৃতিস্থ ছাড়া আর কিছু বলা যায় কি?

হাসল হোমস। বলল, আশ্চর্য কিছু নয়। এখন আর একটা প্রশ্ন। আপনি প্রাতরাশের টেবিলে যেখানে বসেছিলেন, সেখান থেকে জানলা দিয়ে বাইরে দেখা যাচ্ছিল কি?

রাস্তার উলটো দিক আর পার্কের খানিকটা দেখতে পাচ্ছিলাম।

ঠিক বলেছেন। তাহলে আর আপনাকে আটকে রাখব না। আমিই খবর দেব আপনাকে।

উঠে দাঁড়ালেন লর্ড, রহস্য ভেদ করতে পারবেন তো?

রহস্যভেদ হয়ে গেছে।

অ্যাঁ! কী বললেন?

বললাম যে, রহস্যভেদ হয়ে গেছে।

বলুন তাহলে আমার বউ কোথায়?

সেটা শিগগিরই জানব।

আমার তো মনে হয় আপনার বা আমার দ্বারা এ-রহস্যভেদ হবে না–আরও পাকা মাথা দরকার। সেকেলে খানদানি ঢংয়ে বাতাসে মাথা ঠুকে অভিবাদন জানিয়ে বেরিয়ে গেলেন লর্ড।

হাসতে লাগল শার্লক হোমস।

বলল, যাক, আমার মাথাকে লর্ড মশায় নিজের মাথার স্তরে ফেলে সম্মান তো দিলেন। ওহে, জেরা তো অনেক হল, এবার একটু হুইস্কি-সোডা-চুরুটের সদ্ব্যবহার করা যাক। মক্কেল ভদ্রলোক ঘরে ঢোকবার আগেই কিন্তু রহস্য ভেদ করে বসেছিলাম আমি।

মাই ডিয়ার হোমস!

এ-রকম ঘটনার সুরাহা এর আগেও করেছি–তবে এত ঝটপট করিনি। আরে! আরে! লেসট্রেড যে! কী সৌভাগ্য! কী সৌভাগ্য! বসে পড়ো! পাশের টেবিল থেকে গেলাস নাও, চুরুট পাবে এই বাক্সে।

কালো ক্যানভাস ব্যাগ হাতে ঘরে ঢুকল সরকারি গোয়েন্দা। পরনে মোটা পশমি জ্যাকেট আর গলাবন্ধ। অবিকল নাবিকদের মতো দেখাচ্ছে।

লেসট্রেড, চোখ নামিয়ে বললে হোমস, এত মনমরা কেন?

দুর মশাই! চুরুট ধরিয়ে বললে লেসট্রেড, সেন্ট সাইমনের ছাতার বিয়ে নিয়ে নাকের জলে চোখের জলে হয়ে গেলাম।

বল কী হে!

সূত্র-টুত্রগুলো সব পাঁকাল মাছের মতো পিছলে যাচ্ছে।

ভিজলে কী করে?

জাল ফেলতে গিয়ে। সার্পেন্টাইনে জাল ফেলে দেখছিলাম লেডি সাইমনের ডেডবডি পাওয়া যায় কি না।

অ্যাঁ! বলে চেয়ারে এলিয়ে পড়ে পেট ফাটা হাসি হাসতে লাগল হোমস।

হাসতে হাসতেই বললে, ট্রাফালগার স্কোয়ারের ফোয়ারায় জাল ফেললে না কেন?

তার মানে?

ডেডবডি পাওয়ার সম্ভাবনা দু-জায়গাতেই সমান।

কটমট করে তাকিয়ে লেসট্রেড বললে, অনেক কিছু জেনে বসে আছেন মনে হচ্ছে?

খবরটা শোনার সঙ্গেসঙ্গে জানা হয়ে গেছে।

সার্পেন্টাইনে জাল ফেলার সঙ্গে এ-রহস্যের কোনো সম্পর্ক নেই বলতে চান?

আদৌ নেই।

এগুলো তাহলে কী,বলতে বলতে ক্যাম্বিসের ব্যাগ থেকে জলে চুপসোনোকনের পোশাক, জুতো, মালা, ওড়না আর একটি আংটি বার করল লেসট্রেড। দেখি এই ধাঁধার সমাধান করেন কী করে।

জাল ফেলে তুললে মনে হচ্ছে?নীল ধূম্রবলয় শূন্যে উড়িয়ে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললে বন্ধুবর।

আজ্ঞে না। তিক্ত স্বর লেসট্রেডের।জলে ভাসছিল, দারোয়ান দেখতে পেয়ে তুলে এনেছে। বিয়ের পোশাক যেখানে পাওয়া গেছে, কনে বউকেও সেখানে পাওয়া যাবে, এই আশায় জালটা ফেলা হয়েছিল।

অপূর্ব যুক্তি! এই যুক্তির বশেই সব মানুষকেই তাদের জামাকাপড় রাখার আলমারির কাছে পাওয়া উচিত।

আমি কিন্তু এই জামাকাপড় থেকেই প্রমাণ করে ছাড়ব ফ্লোরা মিলারের হাত আছে লেডি সাইমনকে সরিয়ে দেওয়ার পেছনে।

পারবে না, লেসট্রেড, পারবে না।

পারব না? সাংঘাতিক ভুল করে বসলেন কিন্তু মি. হোমস। ফ্লোরা মিলারকে ফাঁসানোর প্রমাণ এই পোশাকেই আছে।

কীরকম?

বিয়ের পোশাকের পকেটে একটা কার্ডের বাক্স পাওয়া গেছে। তার মধ্যে পেয়েছি এই চিরকুটটা। শুনুন কী লেখা আছে :

দেখা করো। এখুনি এসো।
এফ.এইচ.এম.

এ থেকে কি বোঝা যায় না ফ্লোরা মিলারই জপিয়ে নিয়ে গেছে লেডি সাইমনকে? চিঠিখানা গির্জেতে ঢোকার সময়ে পাচার করা হয়েছিল ওঁর হাতে।

চমৎকার! অতীব চমৎকার! তাচ্ছিল্যের সঙ্গে চিরকুটটা হাতে নিল শার্লক হোমস। চোখ বুলানোর সঙ্গেসঙ্গে কিন্তু পালটে গেল চোখ-মুখের চেহারা। নিমেষে তিরোহিত হল ঔদাসীন্য, সে-জায়গায় আবির্ভূত হল নিঃসীম কৌতূহল। বলল চকিত কষ্ঠে, আরে! এ যে দেখছি সত্যিই কাজের জিনিস।

পথে আসুন।

এসে গেছি। অভিনন্দন রইল, লেসট্রেড।

বুক ফুলিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে হঠাৎ আঁতকে ওঠে সরকারি গোয়েন্দা।

আরে মশাই, উলটো দিক দেখছেন কেন?

উলটো কী হে, ওইটাই তো সোজা দিক।

মাথা-টাথা খারাপ হল নাকি আপনার? চিঠি তো এ-পিঠে লেখা।

আর ও-পিঠে লেখা একটা খরচের বিল। দারুণ ইন্টারেস্টিং।

আগেই দেখেছি, কি নেই ওর মধ্যে। চৌঠা অক্টোবর ঘর ভাড়ার জন্যে ৮ শিলিং, প্রাতরাশের জন্য আড়াই শিলিং, ককটেলের জন্যে ১ শিলিং, লাঞ্চের জন্যে আড়াই শিলিং আর এক তোলা শেরি মদের জন্যে ৮ পেন্স খরচ করা হয়েছে। এই তো?

আরে হা, ওর মধ্যেই তো সব কিছু। চিরকুটটাও কম দরকার নয়–নামের আদ্যাক্ষরগুলো কাজে লাগবে।

দেখুন মশায়, আমি হাড়ভাঙা খাটতে ভালোবাসি–আগুনের ধারে আরামে বসে কল্পনাবিলাস আমাকে মানায় না। চললাম, দেখি কে আগে রহস্য ভেদ করে, গজ গজ করতে করতে ভিজে জামাকাপড়গুলো ব্যাগে পুরে নিয়ে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল লেসট্রেড। পেছন থেকে চিৎকার করে হোমস বললে, ওহে একটা কথা শুনে যাও। লেডি সাইমন বলে কেউ নেই, ছিলও না।

তারপর তড়াক করে লাফিয়ে দাঁড়িয়ে উঠে ওভারকোট পরে নিয়ে বেরিয়ে গেল শার্লক হোমস।

এক ঘণ্টা পরে খাবারের দোকান থেকে লোকজন এসে চমৎকার একটা নৈশভোজ সাজিয়ে দিয়ে গেল খাবার টেবিলে। বলে গেল টাকাপয়সা আগেই মিটিয়ে দেওয়া হয়েছে।

রাত নটার সময়ে ফিরল হোমস। মুখ গম্ভীর। চোখ উজ্জ্বল। অর্থাৎ সান্ধ্য অভিযান ব্যর্থ হয়নি।

সোৎসাহে বললে, যাক, খাবার দিয়ে গেছে তাহলে।

পাঁচজনের খাবার দেখছি। অতিথি আসছেন নাকি?

হ্যাঁ। লর্ড সেন্ট সাইমন বোধ হয় এসে গেলেন।

উল্কাবেগে ঘরে ঢুকলেন লর্ড মশায়। ভীষণ বিচলিত মুখে বললেন, এই যে মি. হোমস।

চিঠি তাহলে পেয়েছেন?

তা তো পেয়েছি। কিন্তু যা লিখেছেন, তা কি জেনে লিখেছেন?

মনে তো হয়।

ধপ করে চেয়ারে দেহভার এলিয়ে দিলেন লর্ড সাইমন। কপাল চাপড়ে বললেন, এই অপমানের কাহিনি ডিউকের কানে পৌঁছেলে ওঁর মনের অবস্থাটা কী হবে ভাবতে পারেন?

অপমান বলে ধরছেন কেন–নেহাতই একটা দুর্ঘটনা। ঝোকের মাথায় কাজটা করে ফেলেছেন ভদ্রমহিলা। এ ছাড়া, ওঁর সামনে অন্য পথ ছিল কি?

টেবিল বাজিয়ে চিৎকার করে উঠলেন লর্ড, আপনি শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে চাইছেন। কিন্তু পাঁচজনের সামনে আমার মাথা হেঁট করা কি হয়নি বলতে চান?

ভদ্রমহিলার অবস্থাটাও একটু ভাবুন।

কারো কথা ভাববার দরকার নেই আমার। অত্যন্ত জঘন্য ব্যবহার করা হয়েছে আমার সঙ্গে।

উৎকর্ণ হয়ে হোমস বললে, ওঁরা বোধ হয় এসে গেলেন। লর্ড সাইমন, আমি একজন আইনবিদের সঙ্গে কথা বলে এসেছি–তিনি এ-ব্যাপারে ফয়সালা করে দেবেন। আসুন।

ঘরে ঢুকলেন একজন ভদ্রমহিলা ও ভদ্রলোক। সঙ্গেসঙ্গে চেয়ার ছেড়ে ছিটকে গিয়ে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন লর্ড মশায়।

হোমস বললে, আলাপ করিয়ে দিই। মিস্টার অ্যান্ড মিসেস ফ্রান্সিস হে মুল্টন। মিসেসকে অবশ্য আগেই চেনেন।

মিসেস মূল্টন এগিয়ে গেলেন লর্ডের সামনে। তিনি পকেটে হাত পুরে মুখ ফিরিয়ে রইলেন অন্যদিকে।

মিনতি মাখানো কণ্ঠে ভদ্রমহিলা বললেন, রবার্ট, আমি দুঃখিত।

দুঃখ প্রকাশের কোনো দরকার নেই।

তোমাকে বলে যাওয়া উচিত ছিল আমার। কিন্তু ফ্র্যাঙ্ককে দেখে আর মাথার ঠিক রাখতে পারিনি। অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাইনি এই যথেষ্ট।

আগন্তুক ভদ্রলোক বেশ চটপটে, শানিত মুখচ্ছবি, গায়ের রং রোদে পুড়ে তামাটে হয়ে গিয়েছে। বললেন, ব্যাপারটা বড্ড বেশি গোপন করা হয়েছিল বুঝতে পারছি।

ভদ্রমহিলা বললেন, তাহলে আমিই বলছি আমাদের কাহিনি। ১৮৮৪ সালে ম্যাককোয়ারের ক্যাম্পে ফ্র্যাঙ্কের সঙ্গে আমার আলাপ হয়। জায়গাটা রকি পাহাড়ের ধারে–বাবা খনির কাজ নিয়ে মেতে ছিল ওখানে। ঠিক করলাম আমরা বিয়ে করব। তারপরেই সোনা পেয়ে বাবা বড়োলোক হয়ে গেল–আর কিছুই না-পেয়ে ফ্র্যাঙ্ক দিনকে দিন গরিব হতে লাগল। বাবা বিয়ে দিতে রাজি হল না। আমাকে নিয়ে ফ্রিস্কোয় চলে এল। আমরা কিন্তু লুকিয়ে দেখাসাক্ষাৎ চালিয়ে গেলাম, বিয়ে পর্যন্ত সেরে নিলাম ঠিক হল যদ্দিন না ভাগ্য ফিরছে, তদ্দিন খোলাখুলিভাবে আমার বর হিসেবে নিজের পরিচয় ও দেবে না। কিন্তু কেউ কাউকে ভুলব না।

ও গেল ভাগ্য অন্বেষণে, আমি গেলাম বাবার কাছে। তারপর নানান জায়গা থেকে ফ্র্যাঙ্কের কয়েকটা খবর পেলাম। শেষ খবরটা এল সাংঘাতিক। রেড ইন্ডিয়ানরা একটা তাবু আক্রমণ করে অনেক অভিযাত্রীকে খতম করেছে, তাদের মধ্যে ফ্র্যাঙ্কও আছে।

এক বছর পথ চেয়ে রইলাম। কোনো খবরই যখন পেলাম না, বুঝলাম সত্যিই ও আর নেই। শরীর ভেঙে গেল। বাবা দুনিয়ার ডাক্তার এনে চিকিৎসা করাল। এই সময়ে দেখা হল লর্ড সাইমনের সঙ্গে।

লন্ডনে এলাম। বিয়ের দিন কিন্তু বেদিতে উঠতে যাওয়ার আগেই সিঁড়ির প্রথম ধাপে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে দেখলাম স্বয়ং ফ্র্যাঙ্ককে। ভাবলাম বুঝি ফ্র্যাঙ্কের প্রেতমূর্তি। পুরুতঠাকুরের বিয়ের মন্ত্র কানে ঢোকেনি–সম্মোহিতের মতো ভেবেছি, এ কি সত্যি? হয়তো তখুনি একটা কেলেঙ্কারি করে বসতাম যদি না ফ্র্যাঙ্ক আঙুল নেড়ে আমাকে স্থির থাকতে ইশারা করত। তারপর দেখলাম একটা কাগজে চিঠি লিখছে। যাওয়ার সময়ে ইচ্ছে করে ফুলের তোড়া ফেলে দিলাম–ও তুলে দিল, সেইসঙ্গে চিঠিটা।

চিঠির মধ্যেই নির্দেশ পেলাম কী করতে হবে। আমার স্বামীর নির্দেশ।

বাড়ি গেলাম। অ্যালিসকে সব বললাম। কোট আর টুপি নিয়ে পালিয়ে গেলাম। ঠিক করেছিলাম, সব কথাই লর্ড সাইমনকে পরে বলব–ওই অবস্থায় নিকট আত্মীয় অভ্যাগতদের সামনে বলা সংগত বোধ করিনি।

মিস্টার মুল্টন বললেন, বিয়ের খবরটা একটা কাগজে পড়েই দৌড়ে এসেছি–শুধু গির্জার ঠিকানা পেয়েছিলাম–ওর বাড়ির ঠিকানা পাইনি।

মিসেস মুল্টন কথার খেই নিয়ে বললেন, ফ্র্যাঙ্ক চেয়েছিল সব কথা সবাইকে বলা হোক। আমি কিন্তু ভয়ে লজ্জায় পেছিয়ে এলাম। একঘর লোককে টেবিলে বসিয়ে এসেছি, ফিরব কী মুখে? তাই ঠিক করলাম একেবারেই উধাও হয়ে যাব। বাবাকে কেবল এক লাইন লিখে জানিয়ে দিলাম–আমি মরিনি, বেঁচে আছি। ফ্র্যাঙ্ক আমার জামাকাপড় আংটি পুটলি বেঁধে কোথায় যেন ফেলে এল। কালকেই প্যারিস রওনা হওয়ার কথা আমাদের। এমন সময়ে এই ভদ্রলোক হোমসকে দেখিয়ে, কী করে যেন আমাদের ঠিকানা জোগাড় করে হাজির হলেন বাড়িতে। বুঝিয়ে বললেন, না-বলে চলে আসাটা অন্যায় হয়েছে, একেবারেই চলে যাওয়াটা আরও বড়ো ভুল হবে। উনি বললেন, লর্ড সাইমনের সঙ্গে নিরালা সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেবেন যাতে সব খুলে বলতে পারি। তাই এসেছি। রবার্ট, তোমাকে আঘাত দিয়েছি, আমাকে ক্ষমা করো। নীচ মনে কোরো না।

মুখ চোখ একইরকম কঠোর রেখে সব শুনলেন লর্ড সাইমন। কিন্তু ক্ষমা করলেন না মিসেস মুল্টনকে।

বললেন, ঘরের কেচ্ছা নিয়ে পরের সামনে আলোচনা করতে আমি চাই না।

ক্ষমা না-কর, হ্যান্ডশেক তো করবে?

তোমাকে খুশি করার জন্যে সেটুকু করা যেতে পারে, বলে নিরুত্তাপ ভঙ্গিমায় করস্পর্শ করলেন মিসেস মুল্টনের।

লর্ড সাইমন, বললে হোমস, খেয়ে যাবেন কিন্তু।

ধন্যবাদ। বড্ড বেশি আশা করে ফেলেছেন। ব্যাপারটা ফুর্তি করার মতো নয় আমার কাছে। গুড নাইট।

কাষ্ঠ ভঙ্গিমায়, বাতাসে মাথা ঠুকে ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হলেন লর্ড সেন্ট সাইমন।

তাহলে আসুন আমরাই বসি টেবিলে। আমেরিকানদের আমি ভালোবাসি, মিস্টার মুল্টন। আসুন।

অতিথি বিদায় করার পর হোমস বললে, যে-কেস গোড়ায় বেশি দুর্বোধ্য মনে হয়, সে-কেস শেষে ততই সহজ হয়ে দাঁড়ায়। প্রথম থেকে দুটো ব্যাপার আমার কাছে খুব পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। এক, বিয়েতে ইচ্ছা ছিল ভদ্রমহিলার। দুই, বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরেই বিয়েতে অরুচি দেখা গিয়েছে। মাঝখানে তাহলে এমন কিছু ঘটেছে যে মন পালটে গেছে। কী ঘটতে পারে? কাউকে দেখেছেন কি? যদি কাউকে দেখে থাকেন, নিশ্চয় সে আমেরিকান–কেননা দীর্ঘদিন আমেরিকাতেই থেকেছেন তিনি এদেশের স্বল্পবাসে এমন কেউ ঘনিষ্ঠ হতে পারে না যে ব্যক্তির এত অল্প সময়ের মধ্যে বিয়েতে অরুচি জন্মাতে পারে। তাহলে সে কে? পুরোনো প্রেমিক না, প্রথম স্বামী? যৌবন যার পাহাড় পর্বতে দামালপনার মধ্যে কেটেছে, এ-রকম অতীত তার জীবনে বিচিত্র নয়। গির্জায় সেই সাদামাটা লোকটার কথা তাহলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ফুলের তোড়া সে-ই তো তুলে দিয়েছিল, তারপর থেকেই মেজাজ অন্যরকম হয়ে গিয়েছিল কনে বউয়ের, বাড়ি ফিরে বাপের বাড়ির ঝিকে বলেছেন, জাম্পিং এ ক্লেম। আমেরিকার খনি অঞ্চলের ভাষায় কথাটার মানে হল, যার দাবি আগে, সে নিক আগে। ব্যস, পরিষ্কার হয়ে গেল ব্যাপারটা।

কিন্তু ঠিকানা জোগাড় করলে কীভাবে?

এই একটি ব্যাপারে লেসট্রেড আমাকে সাহায্য করেছে–নইলে মুশকিলে পড়তাম। কাগজটা দেখেই বুঝলাম, ভদ্রলোক গত সাতদিনের মধ্যে লন্ডনের খানদানি একটি হোটেলে উঠেছেন। নামের আদ্যক্ষর পাওয়ায় তাঁকে খুঁজে বার করা আরও সহজ হল।

কিন্তু পেলে কী করে হোটেলটা?

আগুন-দাম দেখে। ওই দামের খাবারদাবার বা ঘরভাড়া লন্ডনের খুব কম হোটেলেই হয়। খুঁজতে খুঁজতে ঠিক পেয়ে গেলাম।

যাঁর জন্যে এত করলে, সেই লর্ড মশায়টি কিন্তু খুব একটা ভালো ব্যবহার করে গেলেন। দরাজ হতে পারলেন না।

হেসে ফেলল হোমস।

বলল, ভায়া ওয়াটসন, যুগপৎ বউ আর যৌতুক হারালে তুমিও কি খুব একটা ভালো ব্যবহার করতে পারতে? দরাজ হতে পারতে? লর্ড সাইমনকে সেইদিক থেকেই বিচার করা উচিত, কৃপা করা উচিত। যাক, বেহালাটা দাও, শরতের নিরানন্দ সন্ধে কাটানোর ওইটেই এখন একমাত্র দাওয়াই।

—————

টীকা

১. খানদানি আইডোর কীর্তিকাহিনি : দ্য অ্যাডভেঞ্চার অব দ্য নোক্ল ব্যাচেলর স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিনের এপ্রিল ১৮৯২ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল।

২. জিজেল বুলেট : আফগান বিদ্রোহীদের ব্যবহৃত বন্দুকের বুলেট।

৩. আহত প্রত্যঙ্গ : আহত প্রত্যঙ্গ কোনটি? একবার ওয়াটসন বলেছিলেন গুলি লেগেছিল কাঁধে। পরে হোমসের কথায় জানা যায় ওয়াটসনের হাতে আঘাত লেগেছিল। আবার কখনো আহত পা-এর কথা শোনা গিয়েছে।

৪. লর্ড সেন্ট সাইমনের : রবার্ট সেন্ট সাইমন যেহেতু ডিউক অব ব্যালমোরালের মেজো ছেলে, বড়ো ছেলে নন, তাই তাঁর পরিচিত হওয়ার কথা লর্ড রবার্ট সেন্ট সাইমন নামে; লর্ড সেন্ট সাইমন হিসেবে নয়।

৫. গ্রসভেনর ম্যানসন : লন্ডন শহরে প্যালেস স্ট্রিট এবং ভিক্টোরিয়া স্ট্রিটের সংযোগস্থলে অবস্থিত সাততলা বাড়ির ফ্ল্যাটের প্রতিটির ভাড়া সেকালে ছিল বছরে তিনশো পাউন্ড। বাড়িটি নির্মাণ শুরু হয় ১৮৫৮-তে। নির্মাণ শেষ হওয়ার সময়ে একটি ফ্ল্যাটও খালি ছিল না।

৬. লাল মলাট দেওয়া একটা বই : কোনো কোনো গবেষকের মতে এটি জেমস ই. ডয়েল সংকলিত পিয়ারেজ : দ্য অফিশিয়াল ব্যারোনেজ অব ইংলন্ড; কিংবা দ্য রেড বুক : অর কোর্ট অ্যান্ড ফ্যাশনেবল রেজিস্টার হওয়া সম্ভব।

৭. প্লান্টাজেনেট : ইংলন্ডেশ্বর দ্বিতীয় হেনরি (অভিষেক ১১৫৪ সালে) থেকে তৃতীয় রিচার্ড (মৃত্যু ১৪৮৫-তে) পর্যন্ত রাজাদের প্লান্টাজেনেট বংশীয় বলা হয়। রাজা প্রথম হেনরির মেয়ে রানি মার্টিলডা এবং কাউন্ট অব আনজাউ, জিওফ্রের বংশধররা হলেন প্লান্টাজেনেট। কাউন্টের টুপির শোভাবর্ধক প্লান্টা জেনিস্টা গাছের পাতা থেকে তার বংশধরদের এই নাম হয়েছে।

৮. টিউডর : ওয়েলস-এর টিউডর বংশীয় পাঁচজন শাসক ১৪৮৫ থেকে ১৬০৩ পর্যন্ত ইংলন্ডের সিংহাসনে বসেন। এঁরা হলেন সপ্তম হেনরি, অষ্টম হেনরি, ষষ্ঠ এডোয়ার্ড, প্রথম মেরি এবং প্রথম এলিজাবেথ। এঁরা হলেন পঞ্চম হেনরির বিধবা পত্নী ক্যাথরিন অব ভ্যালয় এবং ওয়েল টিউডরের বংশাবতংশ। ১৬০৩-এ প্রথম এলিজাবেথের মৃত্যুর পর ইংলন্ডের সিংহাসন যায় স্টুয়ার্টদের হাতে।

৯. মর্নিং পোস্ট : প্রতিষ্ঠা ১৭৭২-এ। রাজপরিবারভুক্ত এবং খানদানি মানুষদের খবরাখবর প্রকাশে এই সংবাদপত্রের খ্যাতি ছিল। ১৮৮১-তে এই কাগজ পরিণত হয় রক্ষণশীল দলের মুখপত্রে। ১৯৩৭-এ ডেইলি টেলিগ্রাফের সঙ্গে মিলিত হয়।

১০. সানফ্রান্সিসকো : আমেরিকার পশ্চিম উপকুলে, ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যে অবস্থিত বন্দর-নগরী।

সেন্ট জর্জ গির্জা : জন জেমসের নকশায় ১৭২১ থেকে ১৭২৪-এ নির্মিত এই অ্যাংলিকান চার্চ বিখ্যাত এখানে অনুষ্ঠিত বহু স্মরণীয় বিবাহের জায়গা হিসেবে। পি. বি. শেলি, বেঞ্জামিন ডিজরেবিন, জর্জ মেরেডিথ, থিয়োডর রুজভেল্ট, জর্জ ইলিয়ট, প্রমুখের বিবাহ অনুষ্ঠিত হয় এই গির্জায়।

১২. ল্যাঙ্কাস্টার গেট : হাইড পার্কের উত্তরে অবস্থিত সারিবদ্ধভাবে তৈরি বাসা-বাড়ি।

১৩. বিয়ের ব্রেকফাস্ট : ১৮৮৭-র আগে পর্যন্ত ইংলন্ডের আইনে বিবাহের অনুষ্ঠান সেরে ফেলতে হত মধ্যাহ্নের আগে। সেই থেকে ব্রেকফাস্ট খাওয়ার প্রথা চালু হয়। পরে আইন বদল হলেও ব্রেকফাস্টের প্রথা রয়েই যায়।

১৪. স্ক্যান্ডিনেভিয়ার : শার্লক হোমসের সঙ্গে স্ক্যান্ডিনেভিয়ার রাজপরিবারের যোগসুত্রর উল্লেখ পাওয়া যায় আ স্ক্যান্ডাল ইন বোহেমিয়া এবং দ্য ফাইনাল প্রবলেম গল্পে।ব্ল্যাক পিটার গল্পেও হোমসের নরওয়ে যাওয়ার খবর পাওয়া যায়।

১৫. সার্পেন্টাইনে : হাইড পার্কের ভেতরে ১৭৩০-এ নির্মিত এই কৃত্রিম হ্রদ ব্যবহৃত হয় নৌকাবিহার এবং সাঁতার কাটার উদ্দেশ্যে। প্রথম দিকে এর জল আসত ওয়েস্টবোর্ন নামের ছোটো খাঁড়ি থেকে। পরে টেমস নদীর সঙ্গে যোগাযোগ ঘটানো হয়।

১৬. ট্রাফালগার স্কোয়ার : ওয়েস্টমিনস্টারের ট্রাফালগার স্কোয়ার উৎসর্গীত ট্রাফালগারের যুদ্ধে মৃত ইংরেজ সেনাপতি লর্ড নেলসনের স্মৃতিতে। স্কোয়ারের উত্তরে পাশাপাশি দুটি ফোয়ারা আছে।

১৭. ফ্রিস্কো : সানফ্রান্সিসকো শহরের সংক্ষেপিত নাম।

১৮. রেড ইন্ডিয়ানরা একটা তাবু আক্রমণ করে অনেক অভিযাত্রীকে খতম করেছে : অ্যাপাচে রেড ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে ঔপনিবেশিকদের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম চলেছিল ঊনবিংশ শতকের শেষভাগ জুড়ে। এই ঔপনিবেশিকদের অধিকাংশ ছিল খনিসন্ধানী। অন্যরা পশুপালন করতেন।

১৯. দেখলাম স্বয়ং ফ্র্যাঙ্ককে : ফ্রান্সিস হে মূল্টনকে হ্যাটি ড্ডারানের বাবা অ্যালসিয়াস ডোরান কেন চিনতে পারল না?

তথ্য সূত্রঃ বাণী ও কথা

Comments

Popular posts from this blog

'মানসা মুসা' পৃথিবীর ইতিহাসের এক শ্রেষ্ঠতম ধনী শাসক

‘আত্মা-রহস্য’ আনিসুল হক

‘দ্য উইন্টার’স টেল’ উইলিয়াম শেকসপিয়র